বর্ষা মৌসুমে (জুন-সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলিতে (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দারবান, রাঙামাটি, এবং খাগড়াছড়ি) পর্যায়ক্রমে পাহাড়ধস ঘটে থাকে। যেসব এলাকায় এধরণের পাহাড়ধস ঘটে, সেখানে প্রধানত তিনটি পৃথক গোষ্ঠী বসবাস করেন। এদের মধ্যে আছেন নগরায়িত পাহাড়ি বাঙালি, আদিবাসী এবং রাষ্ট্রহীন রোহিঙ্গা শরণার্থী। পাহাড়ধসের ফলে এসকল সম্প্রদায় নানা ধরণের জটিল আর্থসামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যার মুখে পড়েন। এই বিষয়টি অধ্যয়নের জন্য ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের (UCL) ‘ইনস্টিটিউট ফর রিস্ক এন্ড ডিজাস্টার রিডাকশন‘ বিভাগের প্রভাষক ডঃ বায়েস আহমেদ গবেষণা করে আসছেন ২০১২ সাল থেকে। সম্প্রতি তাঁর বিজ্ঞান গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য “ল্যান্ডস্লাইডস” জার্নালে, যার শিরোনাম: The root causes of landslide vulnerability in Bangladesh।
পার্বত্য জেলাগুলির পাহাড়ধস সংবেদনশীলতার মানচিত্র। সূত্রঃ ডঃ বায়েস আহমেদ।
ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙ্গন ও খরার মতো প্রাকৃতিক বিপদ-আপদ বিরাজমান। তবে পার্বত্য অঞ্চলে নগরায়ণের প্রবণতার ফলস্বরূপ ভূমিধস বিপর্যয়ের ঝুঁকি ক্রমাগত বেড়ে চলছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বেশ কয়েকটি বিপর্যয়মূলক পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে ২০১৭ সালের জুন মাসে, বর্ষা-বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্ট পাহাড়ধসের ফলে কমপক্ষে ১৬০ জন মানুষ প্রাণ হারান। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্থ হন ৮০ হাজার বাসিন্দা। এর কিছুদিন পরেই ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার থেকে প্রায় দশ লক্ষ রোহিঙ্গা শরণার্থীর আগমন হয়, যা এই অঞ্চলে সংরক্ষিত বন উজাড় এবং পাহাড়ধস পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটায়। শরণার্থীদের থাকার জন্য কক্সবাজার জেলায় প্রায় ৬,০০০ হেক্টর সংরক্ষিত পাহাড়ী বনভূমি কেটে ফেলতে হয়েছে। ধারণা করা হয় যে বর্তমানে এলাকায় তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ মারাত্মক পাহাড়ধস/ভূমিধসের ঝুঁকির মধ্যে জীবনযাপন করছেন। এর মধ্যে নগরায়িত বাঙালি সম্প্রদায়, আদিবাসী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীরা অন্তর্ভুক্ত। এ এলাকায় পাহাড়ধসের ঝুঁকির কারণ অনুসন্ধান করাই ছিল এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। এ গবেষণাটি পাহাড়ধস মোকাবেলা কৌশলের নীতিমালা প্রণয়ন ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠির সম্ভাব্য ভবিষ্যত বোঝার জন্য কাজে আসবে।
“আমি ২০১১ সালে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসাবে কর্মরত অবস্থায় বাটালি হিল এলাকায় পাহাড়ধসে প্রায় ১৯ জন মারা যান। এরপর ২০১২ সালে চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে আবারও ৯০ জন মারা যান। তখন বাংলাদেশে পাহাড়ধস নিয়ে তেমন একটা গবেষণা কিংবা কার্যক্রম হতো না। এই ঘটনাগুলো আমাকে অনেক আবেগপ্রবণ করে তুলে এবং এরপর থেকে আমি বাংলাদেশে পাহাড়ধস নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করি।” – ডঃ বায়েস আহমেদ।
এ গবেষণায় তিনটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহণ করা হয়েছিলো। তথ্য সংগ্রহণের জন্য ডঃ বায়েস অংশগ্রহণমূলক কর্মশালা, বিস্তারিত সাক্ষাত্কার এবং যেসব জায়গায় পাহাড়ধস হয় সেখানে সরাসরি পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি নানাবিধ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছিলেন। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় জনগণ ও পাহাড়ধস বিশেষজ্ঞ। এ গবেষণায় পাহাড়ধস সম্পর্কিত বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সমস্যা, পাহাড়ধসের কারণ চিহ্নিতকরণ এবং পাহাড়ধস হ্রাসে প্রস্তাবিত কর্মপরিকল্পনা চিহ্নিত করা হয়। গবেষণার ফলাফল নির্দেশ করে যে, পাহাড়ি নগরায়িত বাঙালি ও রোহিঙ্গা শরণার্থী সম্প্রদায় পাহাড়ধসের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নগরায়িত পার্বত্য জনগোষ্ঠীগুলি মূলত দারিদ্র্য, সামাজিক অবিচার, নগর পরিকল্পনার অভাব এবং অবৈধভাবে পাহাড় কাটা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে। অন্যদিকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রধান সীমাবদ্ধতা মায়ানমারে চলমান গণহত্যা এবং রাষ্ট্র-কর্তৃক সহিংসতার সাথে সংযুক্ত। গবেষণা অনুযায়ী এ ধরণের পাহাড়ধস দুর্যোগের কারণসমূহ একইসাথে সামাজিক ও প্রাকৃতিক বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করা উচিত। কারণ পাহাড়ধস বিপর্যয়ের উপাদানগুলি মূলত আঞ্চলিক সংস্কৃতি, সংঘাত ও প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির সাথে গভীরভাবে জড়িত।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ধসের ঝুঁকিতে থাকা বিভিন্ন জনগোষ্ঠী। (ক, খ) কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির; (গ) বাটালি পার্বত্য চট্টগ্রাম, (ঘ) লাইট হাউস পাড়া, কক্সবাজারে নগরায়িত পার্বত্য সম্প্রদায়; (ঙ) কাট্রোল পাড়া, খাগড়াছড়ি এবং (চ) বাংলাদেশের বান্দরবান জেলায় সান্দাক পাড়ায় আদিবাসী উপজাতি সম্প্রদায়। সূত্র: বায়েস আহমেদ, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মাঠপর্যায়ের কাজ।
বর্তমানে যে কোন বিপর্যয় ও সে সম্পর্কিত ঝুঁকি বোঝার জন্য দুইটি দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। প্রথমটি বলে যে এ ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা পাহাড়ধস প্রাকৃতিক কারণেই ঘটে। অন্য দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী পাহাড়ধস বিপর্যয় কোন প্রাকৃতিক ঘটনা নয়। বরং এগুলি আর্থ-সামাজিক এবং আর্থ-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন দিকের একটি জটিল মিশ্রণ। প্রচলিত পাহাড়ধস গবেষণার ধারায় ভৌতবিজ্ঞানের গবেষণাই প্রাধান্য পায় যেখানে ঝুঁকি-মানচিত্র ও মডেল তৈরি করে ঝুঁকির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি সম্ভাব্য পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় পাহাড়ধস বিপর্যয় আসলে মানুষ-সম্পর্কিত বিষয়গুলির সাথে জড়িত – যেমন, পরিবেশের অবক্ষয়, টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা, কৃষ্টিসম্পর্কিত/সাংস্কৃতিক বাধা এবং সম্প্রদায়ের ঝুঁকি উপলব্ধি এবং সুশাসনের অভাব।
ডঃ বায়েস আহমেদ চট্টগ্রামের মতিঝর্ণা পাহাড়ে।
ড. বায়েস আহমেদ মনে করেন, “শুধুমাত্র পাহাড়ধসের ঝুঁকি মানচিত্র এবং পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা চালু করেই পাহাড়ধস দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়া সম্পূর্ণভাবে সম্ভব নয়। বরং ব্যক্তি, গোষ্ঠী/সম্প্রদায়, ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পর্যায় থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে গঠনমূলক সচেতনতা বৃদ্ধি এবং পাহাড়/পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জরুরি হল বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে পাহাড়ধসের ঝুঁকি মানচিত্র তৈরি এবং পূর্ব-সতর্কতামূলক ব্যবস্থা চালু করা, নির্বিচারে পাহাড় কাটা বন্ধ করা এবং পাহাড়ে অপরিকল্পিত বনায়ন/উদ্যানপালন না করা।”
তথ্যসূত্র: Ahmed, B. (2021). “The root causes of landslide vulnerability in Bangladesh.” Landslides, 1-14.
Original blog link from বিজ্ঞান ব্লগ।