• blogger
  • facebook
  • linkedin
  • twitter
  • youtube

বাংলাদেশে পাহাড়ধস এবং করণীয়!

বাংলাদেশে পাহাড়ধস একটি আকস্মিক ঘটনা নয়। বৃষ্টির কারণে পাহাড়ধস একটি প্রাকৃতিক ঘটনা হলেও, মূলত মনুষ্যসৃষ্ট কারণেই সাম্প্রতিক সময়ে পাহাড়ধস দুর্যোগ আকার ধারণ করেছে। ১৯৬৮ সালে কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনা সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশে পাহাড়ধস সর্বপ্রথম পরিলক্ষিত হয়। এরপর চট্রগ্রাম বিভাগের পাঁচটি পাহাড়ি জেলায় (চট্রগ্রাম, কক্সবাজার, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) উল্লেখযোগ্য ভাবে ১৯৯৯ সালে ১৭ জন, ২০০০ সালে ১৩ জন, ২০০৩ সালে ৩৭ জন, ২০০৭ সালে ১৩৬ জন, ২০০৮ সালে ২৭ জন, ২০০৯ সালে ১০ জন, ২০১০ সালে ৪৯ জন, ২০১১ সালে ১৯ জন, ২০১২ সালে ৯০ জন, ২০১৫ সালে ৫২ জন এবং সর্বোপরি ২০১৭ সালে এখন পর্যন্ত ১৬৫ জন মারা গেছেন।

পাহাড়ধসের উল্লেখযোগ্য কারণসমূহ হল– নির্বিচারে পাহাড় কেটে বসতি নির্মাণ করা, পাহাড়ি বন এবং গাছপালা কেটে ফেলা, বিপজ্জনক পাহাড়ি ঢালে অপরিকল্পিতভাবে আবাসন গড়ে তোলা, পাহাড় কেটে সমতল বানিয়ে প্লট এবং ফ্ল্যাট বানানো, পর্যাপ্ত ভূতাত্ত্বিক জরিপ ছাড়া পাহাড় কেটে রাস্তা বানানো, পাহাড়ে অসঙ্গতিপূর্ণ চাষাবাদ করা, পাহাড়ে ঘর বানানোর কৌশল, অত্যাধিক জনসংখ্যার চাপ, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং সংশ্লিষ্ট সকল সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঝে সমন্বয়ের অভাব। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, বৈশ্বিক উষ্ণতা, ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড় এবং আকস্মিক ভূমিকম্প পাহাড়ধস তরান্বিত করতে পারে।

গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে শুধুমাত্র ১৯৯০–২০১০ এই ২০ বছরে, পাঁচটি পাহাড়ি জেলায় প্রায় ১,১২৮ বর্গকিলোমিটার পাহাড়ি বন ধ্বংস করা হয়েছে এবং এ থেকে প্রায় ৪২১ বর্গকিলোমিটার এলাকা শহর বা জনপদে রূপান্তরিত হয়েছে (যা কিনা পাহাড় কাটা ইঙ্গিত করে)। এছাড়া এই পাঁচটি জেলা সমগ্র বাংলাদেশের প্রায় ১০% আয়তনের সমান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে এই পাঁচটি জেলায় বিগত ৩০ বছরে (১৯৮১–২০১১) জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। যেমন– রাঙামাটি জেলার জনসংখ্যা বিগত ৩০ বছরে ৩ লক্ষ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে প্রায় ৬ লক্ষ হয়েছে। আর তিনটি পার্বত্য জেলায় (রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান) বর্তমানে প্রায় ৮.৫ লক্ষ আদিবাসী বসবাস করছেন এবং এই জেলাগুলোর জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় সর্বনিম্ন হওয়ায় অনেক সেটলার বাঙালি পাহাড়ে বসবাসের জন্য প্রতিনিয়ত আসছেন।

পাহাড়ে সাধারণত দুই ধরনের গোষ্ঠী/ কমিউনিটি দেখা যায়। একদল হলেন আদি পাহাড়ি অধিবাসী– যারা প্রায় কয়েক শতাব্দী/ অনাদিকাল ধরে পাহাড়ে বসবাস করছেন এবং দ্বিতীয় দলটি হলেন সেটলার/ বসতি স্থাপনকারী বাঙালি [পাহাড়ি আদিবাসী কর্তৃক এই নাম দেয়া হয়েছে]।

সেটলার বাঙালিরা স্থানভেদে প্রায় ২৫ বছর থেকে অতি-সাম্প্রতিক সময়ে এইসব পাহাড়ে বসবাস শুরু করছেন। বিভিন্ন সময়ের তথ্য এবং উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে যে মূলত পাহাড়ে বসবাসকারী সেটলার বাঙালিরাই পাহাড়ধসের সম্মুখীন হচ্ছেন। চট্রগ্রাম শহরের মতিঝর্ণা, বাটালি হিল, মেডিক্যাল হিল এবং গোল পাহাড় এবং কক্সবাজারের বৈদ্য ঘোনা, বাঘ ঘোনা ও বাদশা ঘোনা এলাকা ঘুরে দেখা গিয়েছে যে এখানে বসবাসরত বাঙালিরা মূলত অতি-দরিদ্র আয়ের জনগোষ্ঠী, জীবিকার অন্নেষনে শহরমুখী হচ্ছেন এবং পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধার অভাবে অনেকটা বাধ্য হয়েই ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে বাস করছেন।

যদিও বাংলাদেশের আইনে বেশিরভাগ পাহাড় সরকারী খাস-জমির অন্তর্ভুক্ত এবং পাহাড় কাটা সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, তবুও একশ্রেণীর জনগোষ্ঠী এই পাহাড় কেটে বস্তি আকারে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত এই সকল ভূমিহীন এবং অতীব-দরিদ্র মানুষের বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন। এই সকল পাহাড়ি বস্তি কিংবা অবৈধ এলাকাগুলোতে রয়েছে পানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ। এছাড়াও প্রায় আধা-কিলোমিটারের মাঝে অন্যান্য সুবিধা যেমন- জীবিকার সুযোগ, পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, স্কুল, বাজার, ব্যাংক, খেলার মাঠ, এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা ইত্যাদি থাকায় এই সকল পাহাড়ি বস্তি প্রতিনিয়ত অসংখ্য নিম্নবিত্ত মানুষকে আকৃষ্ট করছে।

প্রতি মাসে বস্তিবাসীর কাছ থেকে ঘর প্রতি প্রায় ১ থেকে ৩ হাজার পর্যন্ত ভাড়া আদায় করা হয়। এখানে জীবিকার প্রধান উৎস হল গার্মেন্টস কর্মী, দিন মজুর, ড্রাইভার, দোকানদার, এবং মুদি/ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। এই সকল পাহাড়গুলোতে এভাবে লাখো মানুষ শুধুমাত্র যে পাহাড়ধসের ঝুঁকি নিয়েই থাকে না বরং উনারা প্রতিনিয়ত নানাবিধ আর্থ-সামাজিক সমস্যারও সম্মুখীন হচ্ছেন। এহেন বৈশিষ্ট্য শুধু চট্রগ্রাম এবং কক্সবাজার নয় বরং বাকি তিনটি পার্বত্য জেলার সদর উপজেলার/শহরতলীর পাহাড়গুলোয়ও বিদ্যমান।

পাহাড়ধসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল (সেটলার) বাঙালি এবং (আদিবাসী) পাহাড়িদের মাঝে সাংস্কৃতিক (Cultural) ঐতিহ্যগত পার্থক্য। পাহাড়িদের বিশেষ উত্তরাধিকারী সূত্রে প্রাপ্ত আদিবাসী জ্ঞান (Indigenous Knowledge) রয়েছে, যার মাধ্যমে উনারা জানেন কোন পাহাড়ের ঢালে কিরূপে এবং কোন ধরনের সরঞ্জাম দিয়ে ঘরটি তৈরী করতে হবে, কিভাবে চাষাবাদ করে পাহাড়ে জীবিকা অর্জন করতে হবে এবং কোন পদ্ধতি অবলম্বন করে এই দুর্গম পাহাড়ি পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। আদিবাসী পাহাড়িরা সাধারণত হালকা উপকরণ (বাঁশ, ছন এবং টিন) দিয়ে ঘর তৈরী করেন যা বাঁশের ভিত্তির উপর পাহাড়ের ঢাল রক্ষা করে বানানো হয়। পক্ষান্তরে বাঙালিরা পাহাড় কেটে ৯০° সমকোণে ঘরের ভিত্তি ও দেয়াল তৈরী করেন এবং ভারী উপকরণ (ইট, সিমেন্ট ও কংক্রিট) দিয়ে ঘর বানান। এ ধরণের ঘরগুলো পাহাড়ি ঢল এবং অধিক বৃষ্টিপাতের মুখে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না এবং এই নকশা বা নির্মাণকৌশল পাহাড়ধসের এবং পাহাড় চাপা পড়ে মানুষের মৃত্যুর অন্যতম কারণও বটে।

বাংলাদেশে পাহাড়ধস সুস্পষ্টভাবে একটি মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। এমতাবস্থায় আমাদের করণীয়সমূহ হল:

[১] প্রতিটি পাহাড়ের বিস্তারিত ভৌগোলিক, ভূতাত্ত্বিক, পাহাড়ি ঢাল, মাটির বৈশিষ্ট্য এবং ভূমি ব্যবহার ইত্যাদি আনুষঙ্গিক সকল জরিপ করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ‘Landslide Hazard’ ম্যাপ প্রস্তুত করা। এর মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় এবং পাহাড়ের ঢালের ঘরগুলোকে চিহ্নিত করা যাবে।

[২] উন্নত GIS, Remote Sensing, Nano-Satellite এবং Web-GIS প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘Landslide Early Warning System’ তৈরী করা, যার মাধ্যমে বিপজ্জনক পাহাড়ে বসবাসরত মানুষদেরকে ৫-৭ দিন আগেই নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া যাবে।

[৩] পাহাড় নির্ভর এই লক্ষাধিক মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা জরিপ করে তাঁদেরকে নিরাপদ এলাকায় পর্যায়ক্রমে সরিয়ে নিতে হবে। তাঁদের জন্য যথাযথ নাগরিক সুবিধা এবং সুশাসন (Social Justice) নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে এই হতভাগ্য পাহাড়-নির্ভর জনগোষ্ঠী সবাই বাংলাদেশের নাগরিক এবং তাঁদেরও আর সকলের মতোই সমধিকার রয়েছে।

[৪] পর্যায়ক্রমে পাঁচটি পাহাড়ি জেলায় বিশেষ করে প্রতি বছর জুন এবং জুলাই মাসে সকল অতি-ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ি ঘরে বসবাসরত জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়ে হবে। এর জন্য ‘Landslide Shelter’ তৈরী করতে হবে।

[৫] পাহাড়ধসে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি রোধে ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের মতো পাহাড়ধসের পূর্বাভাস থাকতে হবে, পর্যাপ্ত ত্রাণ এবং অবকাঠামো সংস্কারসহ পুনর্বাসন কার্যক্রম থাকতে হবে।

[৬] পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ি বন ধ্বংসের ফলে ক্ষতিগ্রস্থ পাহাড়ে পুনরায় প্রকৃত পাহাড়ি বনায়নের (Indigenous Forestry) ব্যবস্থা করতে হবে।

[৭] পাহাড়ে যাতে করে সেটলার বাঙালি এবং আদিবাসী পাহাড়িরা একটি শান্তিপূর্ণ এবং সৌহাদ্যপূর্ণ পরিবেশে থাকতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে; এবং

[৮] সর্বোপরি, পাহাড়ধস, পাহাড় কাটা এবং পাহাড়ি বন ধ্বংস রোধে বাংলাদেশ সরকারকে সংশ্লিষ্ট সকল মন্ত্রণালয় এবং প্রতিষ্ঠানকে সংযুক্ত করে একটি মহাপরিকল্পনা নিতে হবে এবং তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।

I hold the position of Associate Professor at the Department of Risk and Disaster Reduction (RDR) at University College London (UCL). My research experience spans across disaster risk reduction (DRR), conflict and migration, climate change adaptation, genocide diplomacy, community vulnerability assessment, climate mobility, and disaster displacement. I specialise in the intersection of conflict and disaster, with a vision to improve the quality of life of displaced persons and stateless populations. I am driven by a passion for collaborating with frontline communities, aiming to understand their challenges comprehensively and develop actionable policy recommendations to meet their specific needs. My academic journey led me to earn a PhD in Disaster Risk Reduction from UCL, a joint Master of Science degree in Geospatial Technologies from universities in Spain, Germany, and Portugal, and a Bachelor of Urban and Regional Planning degree from the Bangladesh University of Engineering and Technology (BUET).

Leave a Reply